নিমন্ত্রণ ও ভয়ানক রাত
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর পর্ণোদের বাড়ি থেকে বেরোতে অনেক লেট হয়ে গেল। সুনীতা আর পর্ণো'র চক্করে আজ বাড়িতে রণক্ষেত্র বাঁধবে। ইতিমধ্যেই পায়েল ১২ বার কল করে ফেলেছে। পর্ণোদের সঙ্গে হটাৎ স্টেশনে দেখা হয়ে গেছিল। ওরা কি কি সব শপিং করে ফিরছিল, আর আমি ফিরছিলাম অফিস থেকে। সুনীতার সঙ্গে প্রায় ২ বছর পর দেখা, খুব আগ্রহের সঙ্গে বেশ ক্ষানিকটা সময় স্টেশনেই গল্প করে ফিরতে যাব— এরকম সময় পর্ণোর দাবী আজ রাতে ওদের বাড়ি যেতেই হবে! অনেক বুঝিয়েও পারা গেল না। সন্ধ্যে ৭ টা বাজে তখন, আমাকে ৯টার মধ্যে ছেড়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে অবশেষে রাজি হলাম।
সুনীতার সাথে আমার পরিচয় হয় কলেজে, প্রথমের দিকে তেমন একটা কথা বার্তা না হলেও শেষের দিকে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল দারুন গাঢ়। তারপর কলেজের শেষে কে-কোথায়-কিভাবে ছড়িয়ে গেল!
তারপর বছর কিছু পর, কাজের খোঁজ করতে-করতে একদিন আবার হঠাৎ দেখা হয়ে যায় সুনীতার সাথে, সঙ্গে ছিল পর্ণো। আগামী মাসে ওদের বিয়ে। আমাকে আমন্ত্রণ আর থ্রেট দু'টোই এক সাথে করেছিল। যদিও ওদের বিয়েতে আর যাওয়া হয়নি আমার।
অনেকদিন পর রাতে ৪ পেগ খেয়েছি। মানে জোর করে খাইয়েছে বললে সঠিক বলা হবে। পায়েল খুব অপছন্দ করে। সব মিলিয়ে আজ যে কপালে কি আছে!
আপাতত রাত ১১টা ১৫, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে শীতল বাতাস। নেশা জেটুকু হয়েছিল পায়েলের আগাম ভয়ঙ্কর রুপের কথা ভেবেই তা কেটে গেছে। ১ বছর হয়েছে আমাদের বিবাহ। প্রেম করেই। ২ বছর প্রেম তারপর বিয়ে। প্রথম প্রথম রাগ করার অধিকার ছিল শুধু আমার। আজ তার ক্ষুদ্রতম অংশ-ও নেই! প্রথমে ভেবেছিলাম বাড়িই ফিরবনা, তবে সমস্যা আরও জটিল হবে, অগ্যতা নেড়া চলল বেলতলার দিকেই।
অনেকটা হেঁটে আসার পরও কোনো অটো-টোটো না পেয়ে বড় হতাশ হলাম। এই শহরের কি হল! সবে রাত সারে ১১ টা মাত্র। হুহ্, এই দূর্যোগের রাতে, আমার মত লোকের বড়ই অভাব, কাজেই অটো-টোটো পাওয়ার কোনো আশাই আর নেই। পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতে ১ ঘন্টা লাগবে বোধকরি। একা একা যেতে যেতে মনে হতে লাগল এই এদের সাথে আজ দেখা না হলেই ভালো হতো! মিনিট ২০ হাঁটার পর বৃষ্টিটা বড্ড জোরালো ভাবে নেমেছে, সাথে এলোমেলো হাওয়া, ছাতি আর পারবে না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করা শ্রেয় মনে করে একটা বড় গাছের নীচে আশ্রয় নিচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে মেডামের ফোন—
“কোথায় তুমি?”
—“এই তো রাস্তায়, অটো পাইনি, হেঁটে ফিরছি আর আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
—“আচ্ছা, সাবধানে এসো, আমি কি কিছুটা এগিয়ে যাবো?”
—“একদম না পায়েল, অনেক রাত হতেছে, তুমি অপেক্ষা করো আমি আসছি, দুশ্চিন্তার কিচ্ছু নেই।”
—“ঠিকাছে, সাবধানে এসো।”
ফোনটা কেটে বুঝলাম রাতের অশান্তির মেঘ কেটেছে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আবার এগোতে গিয়ে নাকে এক তীব্র গন্ধ প্রবেশ করল। খারাপ না বরং ভালোই, কিন্তু গন্ধের তীব্রতায় মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। বেশ ঘাবড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি এগোলাম বাড়ির দিকে। এবার অন্য এক বিপদ, হটাৎ কানে এলো এক মহিলার কান্না'র শব্দ। প্রচন্ড বেদনায় মানুষ এরকম কাঁদে। এটা আদেও কোনো মানুষ নাকি অন্যকিছু? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বেশ শীত-শীত করছে। একটা সিগারেটে ধরিয়ে প্রায় ছুটতে লাগলাম।
আপাতত বাড়ির কাছে এসে গেছি, সেই তীব্র গন্ধ আর নেই, কান্নার আওয়াজও মিলিয়ে গেছে কোথাও। উফ্! শান্তি!
পায়েল কে ফোন করলাম—
“এসে গেছি, দরজাটা খোলো।”
—“খুলছি, ১ সেকেণ্ড!”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পায়েল এসে দরজা খুলে দিল। ওর মুখে আপাতত চিন্তা আর রাগ মেশা ছাপ।
—“ইশ! একদম ভিজে গেছ যে!”
পায়েল'কে অনেকদিন পর আমাকে নিয়ে চিন্তিত হতে দেখলাম। মৃদু আলোয় ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, মায়াবীও দেখাচ্ছে।
—“আরে হা করে কি দেখছ? একদম ভিজে গেছ, একেবারে স্নান করে এসো, আমি খাবার বাড়ছি।”
পেটে খিদে একদম নেই, তাও ওকে বলতে পারলাম না।
যে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে আমার জন্যে, তাকে সত্যিটা না বলতে পারায় আমার বড্ড অস্বস্তি শুরু হল। আর রাস্তার অদ্ভুতুড়ে গল্পের কথা তো বলাই যাবে না। পায়েল সারাদিন বাড়িতে একা থাকে।
আর কখনও এরকম হটাৎ আমন্ত্রণ গ্রহন করবই না! প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম নিজের কাছেই! 🙉
Comments